শনিবার, ৫ মে, ২০১২

বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৭(২) ধারা: প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমদ সোহেল তাজ।


বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৭(২) ধারা:  প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমদ সোহেল তাজ।
২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ, ৩১ মে পদত্যাগ। এর প্রায় তিন বছর পর সংসদ সদস্যপদও ছাড়লেন তানজিম আহমদ সোহেল তাজ। গতকাল সোমবার বেলা সাড়ে ১১টায় ব্যক্তিগত সহকারীর মাধ্যমে স্পিকারের দপ্তরে পদত্যাগপত্র জমা দেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এই সাংসদ। এর মধ্য দিয়ে রাজনীতি থেকেও দূরে সরে গেলেন তিনি।
পদত্যাগপত্রে সোহেল তাজ লিখেছেন, ‘আমার নির্বাচনী এলাকা ১৯৭, গাজীপুর-৪ (কাপাসিয়া)। আমি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৭(২) ধারা মোতাবেক আপনার নিকট আমার পদত্যাগপত্র পেশ করলাম।’ তিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। চেষ্টা করেও তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী এবং সংসদ সচিবালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব মাহ্ফুজুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, তানজিম আহমদের পদত্যাগের বিষয়টি তাঁরা শুনেছেন। তবে পদত্যাগপত্র তাঁদের হাতে পৌঁছায়নি। স্পিকার আবদুল হামিদ গতকাল ঢাকার বাইরে ছিলেন।
জানা যায়, পদত্যাগপত্র পাওয়ার পর সংসদ সচিবালয়ের সচিব ও আইন শাখার কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক করেন ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী। বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘কয়েকজন সাংবাদিক আমাকে ফোন করে জানিয়েছেন, সোহেল তাজ পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। কিন্তু আমি সংসদ সচিবালয়ে যোগাযোগ করে জেনেছি, তাঁরা এখনো পদত্যাগপত্র হাতে পাননি। স্পিকার যেহেতু দেশে আছেন এবং কার্যত দায়িত্ব পালন করছেন, তাই এ বিষয়ে তিনিই সিদ্ধান্ত নেবেন।
এই পদত্যাগ সরকার বা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে কোনো প্রভাব ফেলবে কি না, জানতে চাইলে ডেপুটি স্পিকার বলেন, ‘কোনো সদস্য যদি মনে করেন, তাঁর ওই পদে থাকা উচিত হবে না, সে ক্ষেত্রে তিনি পদত্যাগ করতেই পারেন। সোহেল তাজ দীর্ঘদিন থেকে সংসদে অনুপস্থিত আছেন এবং সাংসদ হিসেবে তাঁর দায়িত্ব পালন করছিলেন না। সুতরাং, পদত্যাগের সংগত কোনো কারণ তাঁর কাছে থাকতে পারে। তবে তাঁর পদত্যাগ দুঃখজনক। কারণ, আমাদের দেশের রাজনীতিতে তাঁর মতো একজন তরুণ মেধাবী নেতার প্রয়োজন।’
পদত্যাগের পাশাপাশি সোহেল তাজ এলাকাবাসীর উদ্দেশে একটি খোলা চিঠিও লিখেছেন। এতে তিনি পদত্যাগের সুস্পষ্ট কারণ উল্লেখ করেননি। তবে লিখেছেন, ‘বাস্তবতা বিচার করে আমি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছি। কাপাসিয়ার মানুষের সম্মান রক্ষার্থে আমার সামনে এ ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিল না।’ মন্ত্রিত্ব ছাড়ার ব্যাপারে তিনি লিখেছেন, ‘যখন মনে করেছি, আমার সীমিত ক্ষমতায় জনগণের প্রতি দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা সম্ভব নয়, তখন স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছি।’ রাজনীতি থেকে দূরে সরে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি চিঠিতে লেখেন, ‘সক্রিয় রাজনীতিতে ফিরে আসার সম্ভাবনা না থাকলেও আওয়ামী লীগই আমার শেষ ঠিকানা।’
কয়েক দিন আগে সোহেল তাজ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে চিঠি দিয়ে জানতে চেয়েছিলেন, তিন বছর আগে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগের পরও তাঁর ব্যাংক হিসাবে কেন বেতন-ভাতা যাচ্ছে। তিনি এই অর্থ ফেরত দিতে চান।

দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ছেলে তানজিম আহমদ সোহেল তাজ ২০০১ সালের অষ্টম সংসদ এবং ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে গাজীপুরের কাপাসিয়া এলাকা থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন। বর্তমান সংসদে তিনি সর্বশেষ যোগ দিয়েছিলেন ২০১০ সালের ১০ জুন সংবিধান সংশোধন বিল পাস হওয়ার দিন। তার পর থেকে ৫৪ কার্যদিবস অনুপস্থিত আছেন তিনি। সব মিলিয়ে বর্তমানে সংসদে ২৮৮ কার্যদিবসের মধ্যে তাঁর উপস্থিতি ৮৩ দিন।
তানজিম আহমদ বর্তমান সংসদে সদস্যপদ ছেড়ে দেওয়া একমাত্র সাংসদ। সংসদ সচিবালয় সূত্র জানায়, এর আগে অষ্টম সংসদে বিএনপির সাংসদ এবং বর্তমানে বিকল্পধারার নেতা আবদুল মান্নান এবং মাহী বি চৌধুরী তাঁদের সদস্যপদ ত্যাগ করেছিলেন। পঞ্চম সংসদে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বিরোধী দলের সদস্যরা একযোগে ১৯৯৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর পদত্যাগপত্র জমা দেন। কিন্তু তখনকার স্পিকার শেখ রাজ্জাক আলী সাংসদদের স্বাক্ষরের সত্যতার ব্যাপারে প্রশ্ন তুলে পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেননি। অবশ্য সংবিধান অনুযায়ী, টানা ৯০ দিন অনুপস্থিতির কারণে ১৯৯৫ সালের ১৯ জুন তাঁদের সদস্যপদ শূন্য হয়ে যায়।
আইনি বিতর্ক: সোহেল তাজের পদত্যাগ আইনসিদ্ধ হয়েছে কি না, তা নিয়ে সংসদ সচিবালয়ের আইন শাখার কর্মকর্তাদের কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন। কারও কারও মতে, পদত্যাগপত্র স্বহস্তে লেখা হতে হবে। কিন্তু সোহেল তাজের পদত্যাগপত্র কম্পিউটারে কম্পোজ করা।
সাংসদদের পদত্যাগ সম্পর্কে সংবিধানের ৬৭(২) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘কোনো সংসদ সদস্য স্পিকারের নিকট স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে স্বীয় পদ ত্যাগ করিতে পারিবেন এবং স্পিকার—কিংবা স্পিকারের পদ শূন্য থাকিলে বা অন্য কোনো কারণে স্পিকার স্বীয় দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হইলে ডেপুটি স্পিকার যখন উক্ত পত্র প্রাপ্ত হন, তখন হইতে উক্ত সদস্যের আসন শূন্য হইবে।’
অপরদিকে সংবিধানের ইংরেজি পাঠে স্বহস্তে লিখিত পদত্যাগপত্রের কথা বলা আছে। সংবিধানের এজাতীয় বিরোধ সম্পর্কে ১৫৩ অনুচ্ছেদে বলা আছে, সংবিধানের বাংলা ও ইংরেজি পাঠের মধ্যে বিরোধের ক্ষেত্রে বাংলা পাঠ প্রাধান্য পাবে।
কিন্তু সংসদের কার্যপ্রণালি বিধিতে সংবিধানের ইংরেজি পাঠ প্রাধান্য পেয়েছে। ১৭৭ বিধিতে বলা আছে, ‘সংসদের আসন হইতে পদত্যাগ করিতে ইচ্ছুক কোনো সদস্য এই মর্মে স্পিকারকে সম্বোধন করিয়া স্বহস্তে লিখিতভাবে জ্ঞাপন করিবেন যে, তিনি তাঁহার আসন হইতে পদত্যাগ করিতে ইচ্ছুক এবং তিনি পদত্যাগের জন্য কোনো কারণ দর্শাইবেন না।’
সংসদ সচিবালয় সূত্র জানায়, আজ স্পিকার আবদুল হামিদ দপ্তরে আসার পর এ বিষয়ে আলোচনা হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন